Spread the love
গরুটা দেখতে বেশ মোটা-তাজা হয়েছে। তাশরিফ আহসান গরুটিকে তার বন্ধু হিসেবেই দেখে। সে লাল রঙের এই গরুটির নাম রেখেছে ‘লালু’। লালু তাশরিফের কথা বোঝে। কথা শোনেও। ইশকুল থেকে বাড়ি ফিরেই তাশরিফ ‘লালু…’ বলে ডাক দেয়। গরুটি ‘হাম্বা…আ…’ বলে জবাব দেয়।
এই গরুটিকে লালন-পালনের এক বিরাট ইতিহাস রয়েছে। তাশরিফের বাবা ইশতিয়াক আহসান হঠাৎ একদিন বাজার থেকে একটি দুধের গাভী কিনে আনেন। গাভীটির সঙ্গে ছিল একটি লাল রঙের বাচ্চা। চমৎকার বাচ্চাটিকে দেখেই ওর প্রতি তাশরিফের মায়া জন্মে যায়। তখন তাশরিফ ক্লাস টু-তে পড়ছে। বাড়ির আঙিনায় আর পুকুরপাড়ে ইশতিয়াক সাহেব গাভীটিকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখতেন। বাচ্চাটি মায়ের পাশেই ঘোরাফেরা করত। কচি ঘাস খেত। তাশরিফ বাচ্চাটিকে আদর করত। বাচ্চাটি বলতে গেলে তাশরিফের একান্ত বন্ধু হয়ে গেল। তাশরিফ তার বাবাকে বলল, বাবা, আমি এই গরুর বাচ্চাটির একটা নাম দিতে চাই। যে নামে আমি ওকে ডাকব।
বাবা হেসে বললেন, তা বেশ তো। একটা নাম রেখে দাও।
কিন্তু বাবা, কী নাম রাখা যায়?
ওর গায়ের রঙ যেহেতু লাল, তুমি ওর নাম ‘লালু’ রাখতে পার।
বাবার পরামর্শে তাশরিফ তার আদরের গরুবাচ্চাটির নাম রেখেছিল ‘লালু’।
এখন তাশরিফ ক্লাস সেভেনে পড়ছে। ‘লালু’ বড় হয়ে গেছে। লালুর মা অর্থাৎ সেই দুধের গাভীটি আর নেই। তাশরিফের বাবা গাভীটিকে এক বছর পরেই বিক্রি করে দিয়েছিলেন। গাভীটিকে বিক্রি করার সময় তাশরিফ অনেক কেঁদেছে। মা ছাড়া লালু কিভাবে থাকবে, জানতে চেয়েছে বাবার কাছে।
ইশতিয়াক সাহেব বলেছেন, লালু তো এখন বড় হয়ে গেছে। ও এখন আর মায়ের দুধ পান করে না। ঘাস খেতে পারে পেট ভরে। মাকে ছাড়া ও ভালোভাবেই থাকতে পারবে।
কিন্তু বাবা, ওর যদি মায়ের কথা মনে পড়ে যায়, তাহলে?
না তাশরিফ। লালু তোমার সাথে থাকবে, খেলবে। মায়ের কথা মনেই পড়বে না। পশুপাখিরা বড় হয়ে গেলে আর তাদের মা-বাবা, ভাই-বোনের কথা মনে রাখতে পারে না। কারণ তাদের উপর মানুষের মতো এত দায়িত্ব নেই। বাচ্চা বড় হয়ে গেছে। এখন মা-ও ওকে আর আগের মতো ভালোবাসে না, দেখোনি?
হ্যাঁ, দেখেছি তো। মাঝে মাঝে শিং দিয়ে নিজের বাচ্চাকে গুঁতো মারে। দূরে রাখতে চায় বাচ্চাকে।
এই তো, তুমি ঠিক বুঝে গেছো।
এভাবে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দুধের গাভীটিকে বিক্রি করেছিলেন ইশতিয়াক সাহেব। লালু থেকে গেল তাশরিফের কাছে। তখন ও ইশকুলে যাবার সময় লালুকে গাছের সাথে রশি দিয়ে বেঁধে যেত। বলত, দেখ লালু, তুই মজা করে এই ঘাসগুলো খা। আমি ইশকুল থেকে ফিরেই তোকে নিয়ে মাঠে ঘুরতে যাব। ইশকুল শেষ হলে তাশরিফ কাপড়চোপড় খুলেই লালুকে নিয়ে বের হয়ে যেত মাঠে। লালুর গলায় তখন কোনো রশিও থাকত না। মাঠের পাশে লালু ঘাস খেত আর তাশরিফ তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলত। বেলা শেষে খেলা শেষ হয়ে গেলে লালুকে নিয়ে ঘরে ফিরত। লালু ওর সাথে সাথেই হাঁটত। যে কোনো জায়গা থেকে যখন-তখন ‘লালু’ বলে ডাক দিলেই তাশরিফের কাছে ছুটে আসত লালু। অন্যরা ডাক দিলে আসত না। তবে ড্যাব ড্যাব করে তাকাত। যেন বলত, তুমি কেন আমাকে আমার নাম ধরে ডাকছো?
লালুর প্রতি তাশরিফের যে ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। একটি গরুর বাচ্চা দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। মোটা-তাজা এই লাল গরুটির বর্তমান বাজারমূল্য কম করে হলেও দুই লক্ষ টাকা হবে। ইশতিয়াক সাহেব বেশ কয়েকবার গরুটি বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। টাকার দরকার পড়লেই তিনি লালুর দিকে নজর দিতেন। কিন্তু তাশরিফ তা কখনোই হতে দেবে না। তার লাল গরু ‘লালু’ ছাড়া সে একদিনও থাকতে পারবে না। এমনকি ও যখন নানুবাড়িতে বেড়াতে যায় তখনও লালুকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু এতটা পথ গাড়িতে করে লালুকে নেওয়া সম্ভব না। তাই নানুবাড়ি গিয়েও সে বেশিদিন থাকতে চায় না। গতবছর কুরবানির ঈদের সময় লালুকে বাজারে তুলতে চেয়েছিলেন ইশতিয়াক সাহেব। তাশরিফের বাধার মুখে তা সম্ভব হলো না। এবার ইশতিয়াক সাহেব নিয়ত করেছেন লালুকে বিক্রি করবেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের যে অবস্থা তাতে বেশকিছু ধারদেনা হয়ে গেছে। লালুটাকে বিক্রি করে যদি দুই লাখ টাকা পেয়ে যান তাহলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। কুরবানির ঈদের কয়েকদিন আগেই তিনি তাশরিফকে জানালেন বিষয়টি। তাশরিফের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
বাবা বললেন, দেখো তাশরিফ। তোমার লালু এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। আমি জানি তুমি লালুকে অনেক ভালোবাসো। তুমি জেনে খুশি হবে, আমরা লালুকে যার কাছে বিক্রি করব তিনি ওকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি করবেন। তোমার লালু অনেক সৌভাগ্যবান।
লালুকে তো ওরা খেয়ে ফেলবে, তাহলে সৌভাগ্যবান হবে কী করে ও? এটা তো দুর্ভাগ্য বাবা।
না বাবা। তুমি কুরবানির ইতিহাসটা জানো না তো। এসো তোমাকে কুরবানির গল্পটি বলি।
তাশরিফ ওর বাবার কাছে গল্প শুনতে বসে যায়। ইশতিয়াক সাহেব বলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী হযরত ইবরাহিম (আ.)-কে স্বপ্নযোগে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইবরাহিম (আ.) একবার স্বপ্নে দেখেন, আল্লাহতাআলা তাঁকে বলছেন, “হে ইবরাহিম, তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কুরবানি কর।’’ হযরত ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নে এ আদেশ পেয়ে ১০টি উট কুরবানি করলেন। পুনরায় তিনি একই স্বপ্ন দেখলেন। এবার তিনি ১০০টি উট কুরবানি করেন। কিন্তু এরপরেও তিনি একই স্বপ্ন দেখতে পেলেন। তিনি ভাবলেন, আমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কী? অনেক ভেবেচিন্তে তিনি দেখলেন তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-ই তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু। এরচেয়ে প্রিয় পৃথিবীতে আর কিছু নেই। তখন তিনি বুঝতে পারলেন আল্লাহতাআলা তাঁকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহর কাছে দুআ করে এই পুত্র সন্তান লাভ করেছিলেন। এখন কিভাবে নিজের পুত্রকে নিজেই কুরবানি করবেন?
অনেক ভেবে ইবরাহিম (আ.) সিদ্ধান্ত নিলেন। আল্লাহর আদেশ তো আর অমান্য করা যায় না। তিনি তাই নিজের প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর কাছে গেলেন। বললেন, প্রিয় ইসমাইল! আমি স্বপ্নে আল্লাহর নিকট থেকে আদেশ পেয়েছি তোমাকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি করতে হবে।
হযরত ইসমাইল (আ.) মুচকি হেসে বললেন, বাবা, আপনি আল্লাহর আদেশ নিঃসংকোচে পালন করুন। আল্লাহর ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। আল্লাহর হুকুম পালনে আমি আপনাকে বাধা দিতে পারি না। আমি বুঝতে পারছি আপনার কষ্ট হবে। আমি আপনাকে সহযোগিত করব। আসুন, ছুরি লাগান।
হযরত ইবরাহিম (আ.) সেদিন আরাফাত পর্বতের উপর তাঁর পুত্রকে কুরবানি দেওয়ার জন্য গলদেশে ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন। তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে তাঁর পুত্রের পরিবর্তে একটি দুম্বা কুরবানি হয়েছে এবং তাঁর পুত্রের কোনোই ক্ষতি হয়নি। দিনটি ছিল ১০ জিলহজ্ব। এ ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহতাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর এই দিবসটি ঈদ উল আদহা নামে উদযাপন করে। আমরাও প্রতিবছর সাধ্য অনুযায়ী কুরবানি করি।
তাশরিফ তার বাবার বলা গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। গল্প বলা শেষ হতেই সে বলল, বাবা তাহলে লালুকে আমরা কুরবানি করি। আমি নিজে লালুর গলায় ছুরি চালাব। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাকে পুরস্কৃত করবেন।
তুমি ঠিক বলেছো বাবা। কিন্তু আমাদের তো সামর্থ্য অনুযায়ী কুরবানি করতে হবে। কুরবানি শব্দের অর্থ ‘ত্যাগ’। আমরা লালুকে বিক্রি করছি মানে এটাও এক ধরনের ত্যাগ। মানে কুরবানি। আর লালুকে যারা কিনে নেবে তারা ওকে আল্লাহর নামে কুরবানি করবে। আমরা লালুকে বিক্রি করা টাকা থেকে একটি অংশ দিয়ে একটি খাসি কিনে কুরবানি দিতে পারব। বাকি টাকা আমার ব্যবসার কাজে লাগাব।
না, বাবা। লালু আমার। আমি লালুকেই কুরবানি দেবো। অন্য পশু কুরবানি দেবো না। আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু লালুকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি করতে চাই।
অবশেষে তাশরিফের জোরাজুরিতে ইশতিয়াক সাহেব লালুকে বিক্রির পরিবর্তে কুরবানি করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি অবশ্য কুরবানির শেয়ার বিক্রি করেন। লালুর বাজারমূল্য দুইলক্ষ টাকা নির্ধারণ করে দুজন প্রতিবেশীকে সম্পৃক্ত করেন কুরবানিতে। উনারা দুই নাম করে মোট চার নাম কুরবানি দেন। আর ইশতিয়াক সাহেবদের অংশে থাকে তিনভাগ। কুরবানির ঈদের দিন সকালবেলা ঈদগাহ থেকে সালাত আদায় করে এসেই লালুকে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবেহ করা হয়। লালুর লাল রক্তে ভেসে যায় বাড়ির আঙিনা। তাশরিফের মনে অনেক কষ্ট লাগে। কিন্তু সেই কষ্টের মধ্যেই সে একধরনের আনন্দ উপভোগ করে। আল্লাহর কাছে দুআ করে। আল্লাহকে বলে, হে আল্লাহ! তুমি আমার এ কুরবানি কবুল করো।
ঈদের তিনদিন পর ইশতিয়াক সাহেব বাজার থেকে আবার একটি দুধের গাভী কিনে আনেন। এবারও গাভীটির সঙ্গে একটি লালরঙের বাচ্চা। তাশরিফ অবাক হয়ে বলে, বাবা এ কী! এ তো একদম সেই ছোট্ট লালু!
হ্যাঁ, বাবা। এটা অবিকল তোমার লালুর মতোই।