বুঝলা আমেনার মা, আগে রিকশা নিয়া সাহেবগো লগে কত বেটাগিরি দেহাইতাম! দশ টিয়ার ভাড়ায় বিশ টিয়া আদায় করতাম। আর অহন…।
আমারও তো হেই একই অবস্থা। যে বাসায় কাম করতে যাইতাম হেরা তো দরজা লকডাউন দিয়া রাখছে। কী আজব এক বেমার আইলো কও দেহি।
এহন খাওন-দাওন কী করুম কও? কিছু কি বানাইছো?
খালি আলু সেদ্ধ দিছি। ৩টা আলুই ছিলো ঘরে।
দেও, পোলাপানগো হাতে দিয়া দেও।
আপনেরে আধখান দেই…।
না, দরকার নাই। আমেনারে একটা আর শফিকরে একটা দিয়া দেও। হেরা বাইচ্চা মানুষ। আর একটা আলু রাইখ্যা দেও। যদি কপালে কিছু না জুটে রাইতের বেলা খাইবো।
এ্যাই রহিম মিয়া। রহিম মিয়া। খবর পাও নাই। উত্তরপাড়ায় চেয়ারম্যান সাব রিলিফ দিতেছে।
কন কি মিয়া ভাই। মুই অহনই যাইতাছি।
রহিম মিয়া রিকশা নিয়ে বের হলো। রিকশায় চড়ে বসল মতি, মোখলেস আর রুবেল। ৩ জন মানুষ রিকশায় বসার পরও রহিম মিয়ার প্যাডেল ঘুরতে আছে ঘোড়ার গতিতে। পেটে ভাত পড়েনি আজ প্রায় ৪ দিন হতে চলল। তবুও গায়ে এত শক্তি রহিম মিয়া পায় কই?
এ্যাই রহিম ভাই, গায়ে এত বল পাইলা কই? তোমাগো ঘরে কি খাওন-দাওন খুব ভালোই চলছে?
মতি মিয়ার প্রশ্নে মাথার মগজটা কেমন জানি করতে লাগল রহিমের। বুকের ভেতর কেমন একটা কষ্ট অনুভূত হলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকেই রিকশা চালাইতে লাগল।
আরে ধুর মতি ভাই। রহিম মিয়া খাওন পাইব কই। মোরা হক্কলে তো এক বস্তিতেই থাহি। মুই যতটুক জানি, রহিম ভাই আজ ৪ দিন হলো খাওন-দাওন পায়নি। মোগো এলাকায় তো রিলিফ আহে না।
রহিম মিয়ার নীরবতা দেখে মোখলেসই উত্তর দিল।
রুবেল বলল, কী কও মতি ভাই। রিলিফ না আইলে কী অইব? রহিম ভাই রিকশা চালায় না? রিকশা নিয়ে বাইর হইলেই তো কত টেহা-পয়সা মিলে।
বাম হাতে পিঠের গামছা টেনে চোখ মুছল রহিম মিয়া। পায়ে প্যাডেল চালাচ্ছে সেই আগের গতিতেই। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, নারে ভাই, আগের দিন অহন আর নাই। এই করোনার কালে রিকশা চড়ব কেডা? যাইব কই? দেখস না সবকিছু লকডাউন দিয়া রাখছে।
উত্তর পাড়ার কাছাকাছি এসে গেছে রিকশা। পয়েন্ট থেকে বাঁ দিকে যেতেই রিকশার গতি থামাল টহলরত পুলিশ।
এ্যাই বেটা, রিকশায় গাদাগাদি করে কয়জন উঠাইছস?
রহিম মিয়ার কোমরের ঠিক ওপরে মেরুদণ্ডের হাড্ডিতে গিয়ে পড়ল পুলিশের লাঠির বাড়ি। সিট থেকে নেমে হাতজোড় করল রহিম মিয়া।
স্যার, মোরা রিলিফ আনবার যাইতাছি। হুনছি উত্তরপাড়ার চেয়ারম্যান সাব রিলিফ দিতেছে।
পুলিশ পাত্তাই দিলো না রহিম মিয়ার কথায়। সিটে বসা ৩জনের দিকে লাঠি নিয়ে এগিয়ে গেল।
এ্যাই মিয়া, আপনাদের মাস্ক কোথায়?
রুবেলের মুখে ময়লা একটা মাস্ক ছিলো। কিন্তু মতি আর মোখলেসের মুখে কোনো মাস্ক ছিলো না। তারা ৩ জনই নেমে দাঁড়াল রাস্তায়।
একজন কনস্টেবল এসে ৩ জনের পাছায় ঠাস ঠাস করে ডাণ্ডা লাগাল। পড়িমরি করে এরা ৩ জন দৌড় দিলো উত্তর পাড়ার দিকে।
রহিম মিয়া রিকশা নিয়া সামনে যেতে চাইল। একটা কনস্টেবল এসে বলল, এ্যাই বেটা যাস কই? তোর তো জরিমানা হবে ১০০০ টাকা।
কন কী স্যার? জরিমানা কিয়ের লাই?
শালা বুঝস না? রিকশায় ৩ জন প্যাসেঞ্জার উঠাইছস ক্যান? একজনের বেশি উঠাইতে পারবি না।
স্যার ভুল হয়ে গেছে মাফ কইরা দ্যান।
অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হয়। এটা কোনো ভুল নয় যে মাফ চাইবি।
স্যার, মোর কাছে তো কোনো টেহা-পয়সা নেই।
আচ্ছা, যা। জরিমানা মওকুফ। ১০০ টাকা দেয়, পান-সিগারেট খামু।
মুই ১০০ টিয়া কই পামু সাব, আমগো এহন কোনো আয় রোজগার নাই। ঘরে বউ পোলাপান উপোস রইছে!
ঠিক আছে তাহলে যা। এই নেয় তোর জরিমানাটা লইয়া যা। রিকশার চাকায় হাত দিলো কনস্টেবল। একটা একটা করে ৩টি চাকারই হাওয়া ছেড়ে দিলো।
রহিম মিয়া হাত জোড় করে কান্নাকাটি করল, আল্লাহর দোহাই দিলো। কোনো কথাই শুনল না পাষাণ কনস্টেবল। পাশে দাঁড়ানো অন্যান্য পুলিশ এদিকে ফিরেও তাকাল না। কী হচ্ছে বা কী ঘটল কিছুই টের পেল না কেউ।
রহিম মিয়ার রিকশার টায়ারে এখন বাতাস নেই। গ্যারেজও বন্ধ। রিকশা টেনে টেনে এগিয়ে চলল সে উত্তরপাড়ার চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে। যাওয়ার পথে শুনতে পেল লোকজন বলাবলি করছে, সরকারি রিলিফ আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি দরিদ্র লোকের ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে বলেছেন। এই রিলিফ যেই সেই রিলিফ না। প্রত্যেক পরিবারের জন্য প্রতি ১ সপ্তাহের খাবারের প্যাকেট করা হয়েছে। রহিম মিয়ার মনের সকল দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য আল্লাহর দরবারে হৃদয়ের গভীর থেকে দোয়া করল রহিম মিয়া। রিকশা টানতে টানতে রহিম মিয়া একসময় গিয়ে পৌঁছে গেল উত্তরপাড়ার চেয়ারম্যান বাড়িতে। মতি, মোখলেস আর রুবেল তার লাগি অপেক্ষা করতেছে। রহিম মিয়া লাইনের প্রায় মাঝখানেই জায়গা পেল। সব মতিদের চালাকি। তারা দাবি করল, এই লোক কিছুক্ষণ আগেও এখানে ছিল। লাইনের ৩ জন সাক্ষ্য দিলে অন্যরা আর কথা বাড়াল না।
এ্যাই মতি, কী কী দিতেছেরে রিলিফের ব্যাগে? জিজ্ঞেস করল রহিম মিয়া।
হুনছি, ১০ কেজি চাইল, ২ কেজি ডাইল, ২ কেজি সোয়াবিন তৈল, ১ কেজি আটা, ১ কেজি লবণ আর ৫ কেজি আলু।
রহিম মিয়ার মনটা আনন্দে নেচে উঠল। সত্যিই তো এক সপ্তাহ ভালোমতো খাওন-দাওন করা যাইবো। এক সপ্তাহ ক্যান, অল্প অল্প করে খাইলে আধা মাস কাটানো যাইব এগুলা দিয়া। রহিম মিয়ার চোখে আবারও অশ্রু নেমে এলো। এটা অবশ্যই কষ্টের না, আনন্দের অশ্রু। গামছা দিয়ে চোখ মুছল রহিম মিয়া।
সবার হাতে হাতে রিলিফের বস্তা চলে এসেছে। কিন্তু সবাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হলো। ফটো উঠানো হবে। ভিডিও হবে। লাইভ হবে। টিভি ক্যামেরা এসেছে। সবাই দাঁড়িয়ে রইল। এভাবে সারাদিন দাঁড়ালেও কষ্ট হবে না কারো। কারণ সবার কাঁধে রিলিফের বস্তা রয়েছে। ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে অনেকগুলো ছবি উঠানো হলো। সাংবাদিকেরা ক্যামেরায় ধারণ করল ছবি। টেলিভিশনে লাইভ নিউজ হলো। রহিম মিয়া, মতি মিয়া, মোখলেস, রুবেল সবার মুখই ক্যামেরায় উঠছে। তারা হাত নাড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ করল ক্যামেরার সম্মুখে। সবার আনন্দিত মুখ এতক্ষণে নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গণভবনেও। গরিব-দুখীদের মুখে এমন আনন্দ তুলে দিতে পেরে তিনিও নিশ্চয়ই মুচকি হাসি দিচ্ছেন।
অনুষ্ঠান শেষ। সাংবাদিকরা চলে গেলেন। চেয়ারম্যানের সেক্রেটারি বলল, সবাই রিলিফের বস্তাগুলো এখানে রাখেন। কেউ বুঝে আর কেউ না বুঝেই কাঁধ থেকে রিলিফের বস্তাগুলো নামিয়ে রাখল। এবার নির্দেশ এলো, সবাই যার যার ঘরে চলে যান।
একজন বলল, কী কন আপনে? মোরা রিলিফ নিতে আইছি। রিলিফ নিয়াই যামু।
হইচই শুরু হলো চারদিকে। উত্তেজিত হলো গরিব জনতা। চেয়ারম্যানের দেখা নেই। কয়েকজন লাঠিয়াল এসে আচ্ছা মতো লাঠিপেটা করতে শুরু করল। সবাই ভোঁ দৌড় দিলো। প্রাণ বাঁচাতে ত্রাণের আশা ছেড়ে দিয়ে দৌড় শুরু করেছে সবাই।
রহিম মিয়া রিকশা টানতে টানতে বস্তির দিকে যাচ্ছে। তার চোখে ভাসছে ৪ দিন থেকে না খাওয়া ৩ বছরের শিশু আমেনার ছবি। ৫ বছরের শিশু শফিকের ছবি। একটা সিদ্ধ আলুর অর্ধেক খাবে আমেনা, অর্ধেক শফিক। রহিম মিয়া ও তার বউ মর্জিনা থাকছে না খেয়েই। এরপর রাত আসবে। ঘুমিয়ে পড়বে সবাই। সকাল হলেই শূন্য থালা। রহিম মিয়া রিকশা টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটি বটগাছের নিচে ছায়া দেখে বসে পড়ল সে। তার বুকটা কেমন জানি করছে। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে কেন? কলজেটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে মনে হলো। বাঁধভাঙা জোয়ার নেমে এলো বানের পানির মতো চোখ দিয়ে। সে চিৎকার করে উঠল, ‘আল্লাহ গো…’ বলে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল রহিম মিয়ার কণ্ঠ।